স্মরণ:
মানবতবাদী চিকিৎসক ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান
গাজী
সাইফুল ইসলাম
আজ ১০ এপ্রিল ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার জনক ডা. খ্রিশ্চিয়ান ফ্রেডরিক স্যামুয়েল হ্যানিম্যানের ২৬০তম
জন্মদিন। এইদিনে ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির
মিসেন নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
Dr. Samuel Hahnemann |
হ্যানিম্যান ছিলেন এলোপ্যাথি
চিকিৎসাশাস্ত্রে একজন চিকিৎসক। কিন্তু
শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন ও মানবতাবাদী। তাঁর
সময়ে তাঁর দেশে শাস্ত্রমতে চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন রোগীর রোগ
সম্পূর্ণ আরোগ্য হচ্ছে না, চিকিৎসা গ্রহণের পর কোনো কোনো রোগীর দুর্ভোগ আরও বেড়ে যাচ্ছে। এসব দেখে তিনি মনে মনে খুবই কষ্ট পাচ্ছিলেন আর ভাবছিলেন ওষুধ
ও পদ্ধতি দুই-ই কীভাবে উন্নত করা যায়। বিদেশে গিয়ে গ্রহণ করেন এমডি ডিগ্রি। কিন্তু তাতে তাঁর নিজের শিক্ষা বাড়লেও ওষুধ আর পদ্ধতিতে কোনো
গুণগত পরিবর্তন ঘটেনি। ফলে চিকিৎসার
ফলাফল একই থেকে যায়। এ পর্যায়ে
তাঁর এক আত্মোপলব্ধি হয়, ‘‘আমি এতদিন
যত রোগীর চিকিৎসা দিয়েছি-চিকিৎসা না নিলেও তারা এর চেয়ে ভাল থাকতেন।’’ এরপরও তিনি ভাবছিলেন কীভাবে মানুষকে সঠিক চিকিৎসাসেবা দেয়া যায়। কিন্তু কোনো উপায় আবিষ্কার করতে না পেরে হতাশাগ্রস্থ চিকিৎসক
চিকিৎসা পেশাই ত্যাগ করেন এবং বিজ্ঞানগ্রন্থের অনুবাদকর্মে আত্মনিয়োগ করেন। একইসঙ্গে বহু ভাষায় দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা চালান। এভাবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই অনুবাদ করে অনুবাদক হিসেবে তিনি
খ্যাতিমান হয়ে যান। এমনই একদিন ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে
তিনি জার্মানির এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা. উইলিয়াম কালনের ‘এ ট্রিয়েটিস
অন মেটেরিয়া মেডিকা’ বইটি
ইংরেজি থেকে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করার সময় এক জায়গায় দেখতে পান যে, ‘‘ সিঙ্কোনা বা পেরুভিয়ান বার্ক’ সুস্থ শরীরে প্রয়োগ করলে ম্যালেরিয়ার
রোগ সদৃশ কম্পজ্বরের লক্ষণাবলি উৎপাদন করে।’’ এই সূত্র
ধরেই ১৭৯০ সালে তিনি নিজ শরীরে সিঙ্কোনার ছাল প্রয়োগ করে দেখেন যে, ডা. কালনের কথা সত্য। এই পরীক্ষা থেকেই তিনি তাঁর ÔÔSimilia Similibus Curentur.ÕÕ ধারণাটি পান। এরপর এক এক করে তিনি ৯০টি (মতান্তরে
৯৯টি অথবা ১৩০টি) ওষুধের ওপর পরীক্ষা চালান এবং ফলাফল লিপিবদ্ধ করেন। এসব ফলাফল থেকেই ১৭৯৬ খ্রিস্টাবে তিনি তাঁর চিকিৎসা পদ্ধতির
নাম ‘হোমিওপ্যাথি’ ঘোষণা করেন।
ডা. হ্যানিম্যানই প্রথম বিশ্ববাসীকে
শিক্ষা দেন যে, চিকিৎসা শুধু পেশা নয় জীবনের মহৎ কর্তব্য। চিকিৎসা শব্দটির সঙ্গে সেবা শব্দটির যোগ আছে। রোগ ও রোগীর সেবা। মানবজাতিকে
রোগযন্ত্রণা থেকে আরোগ্যদানের উদ্দেশ্য যারা নিজেদের নিয়োজিত করেন তারা চিকিৎসক। আর সেবা শব্দটির জন্যই চিকিৎসা একটি মহৎ, পবিত্র ও মানবীয় পেশা। বহু শতাব্দি ধরে এ পেশার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে মহামানবগণ প্রাণান্ত
পরিশ্রম করেছেন। আগেকার দিনে একটি রোগকে জয় করার
জন্য বিজ্ঞানিরা ছিলেন নিবেদিত, আবিষ্কারকগণ উৎসাহী আর চিকিৎসক জীবনব্যাপী অনুসন্ধানী। কেউ কেউ একাই লড়েছেন বিরুদ্ধ পরিস্থিতির সঙ্গে। যেমন ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান। কিন্তু
গত অর্ধ শতাব্দি ধরে মানুষ মানবিক মূল্যবোধ জলাঞ্জলি দিয়ে প্রতিটি পদক্ষেপে হয়ে গেছে
হিসাবি। ফলে তারা মহান পেশাকে নানাভাবে
হেয় করছে, অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, হাসপাতাল-ক্লিনিক, দালাল, প্যাথলজিক্যাল ল্যাব, ডায়াগনেস্টিক সেন্টার, ওষুধ বিক্রেতা, দেশি-বিদেশি কোম্পানি ইত্যাদি নানা নামে রোগীকে সর্বশান্ত করার জন্য দেশে বিদেশে
গড়ে উঠছে অসংখ্য চক্র।
মানুষ যখন অর্শ, ক্যান্সার, ভাইরাস সংক্রমণের মতো কঠিন রোগে
আক্রান্ত হয়-খুব অসহায় হয়ে পড়ে। প্রিয়জন
কিংবা নিজেকে বাঁচানোর জন্য দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে-সবচেয়ে নির্ভর ও বিশ্বাসযোগ্য চিকিৎসকের
খুঁজে। চিকিৎসক তার জ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষা সবকিছু নিয়ে দাতা
বন্ধুর মতো তার পাশে দাঁড়াবেন, স্বল্প সময়ে, কম কষ্ট দিয়ে স্থায়ী আরোগ্য
দান করবেন। এতটুকুই সবার দাবী। কিন্তু চিকিৎসক যদি উপযুক্ত জ্ঞানের অধিকারী না হন, মানবীয় গুণসম্পন্ন না হন, অর্থপাগল হন-তাহলে তার চিকিৎসায়
রোগী শুধু শারীরিক মানসিক বঞ্চনাই পাবে-আরোগ্য নয়।
ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান এলোপ্যাথিক
চিকিৎসায় ব্যর্থতা দেখে এমডি হয়েও সরে দাঁড়িয়েছিলেন। সুযোগসন্ধানীর মতো অর্থ উপার্জনে মনোযোগ না দিয়ে সৎভাবে বাঁচার জন্য অনুবাদ কর্মে
আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তবু পেশার
অমর্যদা করেননি। আজ তাই তাঁর জন্মদিনে ব্যক্তি
ও চিকিৎসক হ্যানিম্যানকে তাঁর মানবতাবাদী চিন্তার জন্ম এবং সহজ ও ফলপ্রসু একটি চিকিৎসা
ব্যবস্থা উপহার দেয়ার জন্য শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
লেখক, অনুবাদক ও হোমিওপ্যাথির গবেষক
Hi friends read my articles
উত্তরমুছুন