ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান ২৬০তম জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি
হোমিওপ্যাথিক দর্শন মানব কল্যাণের দর্শন
গাজী সাইফুল ইসলাম
দর্শন মানে অধিবিদ্যা বা জ্ঞানবিদ্যা যা জীবন ও জগৎ নিয়ে আলোচনা করে। মন, আত্মা ও সত্তা নিয়ে আলোচনা করে। জন্ম-মৃত্যুর
রহস্য, জন্মের আগে কী ছিল এবং মৃত্যুর
পরে কী হবে এমনসব বিষয় নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা কর। দার্শনিকদের কেউ বলেছেন ‘ভাব’ই আসল কেউ বলেছেন
‘বস্তু’। কেউ বলেছেন ঈশ্বর
আছেন কেউ বলেছেন নেই। কেউ এ দু’য়ের মাঝ থেকে বেরিয়ে নিজেকেই ‘ঈশ্বর’ ঘোষণা করেছেন। কেউ বলেছেন, ‘‘আমি চিন্তা করি তাই আমি আছি’’। কেউ বলেছেন, ‘‘আমি নেই তাতে কী জগৎ আছে বহুদূর পর্যন্ত
বিস্তৃত আমি দেখি বা না দেখি’’। এভাবেই যুগে যুগে দার্শনিক চিন্তা গড়ে উঠেছে, আবর্তিত হয়েছে এবং দর্শনচিন্তার মধ্যে
শ্রেণিবিভাগ সৃষ্টি হয়েছে। আমরা পেয়েছি জড়বাদ, ভাববাদ (আদর্শবাদ) ও বস্তুবাদ নামের দর্শনচিন্তা। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক দার্শনিকগণ এই ঘরানা থেকে বেরিয়ে দর্শনের
আওতাকে বড় করে এর সৌন্দর্যে আরও কিছু পালক যোগ করার প্রয়াসী হননি। যদিও এসব ‘ইজম’এ বহুমতের মিলন
ঘটেছে কিন্তু বিতর্কও কম সৃষ্টি হয়নি। এমন বিতর্ক ও আলোচনা-পর্যালোচনা থেকে বহু দূরে অবস্থান নিয়ে একজন মানবতাবাদী চিকিৎসক
দর্শন চিন্তার মোড় ঘুরিয়েছে দিয়েছেন। আমরা যাকে বলি
মানব কল্যাণের দর্শন। আর এর মাধমে তিনি
জগতকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছেন, আলোকিত ও অলঙ্কৃত করেছেন। এই মহান ব্যক্তিটি
আর কেউ নন-হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাবিদ্যার জনক ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান। যদিও তাঁর আগে
গ্রিক দার্শনিক হিপোক্রিটাসের মাথায় এসব চিন্তার উদয় হয়েছিল কিন্তু তিনি তাঁর সে চিন্তার
পূর্ণতা দিয়ে যেতে পারেননি। যদিও হিপোক্রিটাসই
প্রথম ব্যক্তি যিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গে মানবতাবাদী চেতনার সংযোগ ঘটিয়েছিলেন।
রোগাক্রান্ত জীবনীশক্তি রোগীর দেহ ও মনে কতকগুলো যন্ত্রণা ও বিকৃতিমূলক লক্ষণ প্রকাশ
করে। চিকিৎসকগণ ওই লক্ষণ ধরে লক্ষণের সঙ্গে
মিলিয়ে সূক্ষ্মশক্তির ওষুধ ¯^ígvÎvq প্রয়োগ করে রোগীকে আরোহ্যানিম্যান রসকসহীন দর্শনের কচকচানি থেকে দার্শনিক চিন্তাকে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত করে চিকিৎসা দর্শনকে আগাগোড়া বদলে দিয়েছেন। প্রচুর ভর্ৎসণা ও বিতর্ক সত্ত্বেও তাঁর চিন্তা জগতে অবধারিতরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
হোমিও দর্শনের মূল শব্দযুগলটি হলো ‘জীবনীশক্তি’। ডা. হ্যানিম্যান বলেছেন: জীবনীশক্তি অতীন্দ্রিয়, মানব দেহের এর অবস্থান আছে কিন্তু দেখা যায় না, ধরা-ছোঁয়া যায় না। জীবনীশক্তিই সুস্থ মানবকে প্রাণবন্ত ও উজ্জীবিত রাখে আর অসুস্থ মানবকে সুস্থ করে তোলার জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে কর্মতৎপরতা চালায়। জীবনীশক্তিবিহীন মানবদেহ একটি জড়পিণ্ড ছাড়া কিছু না। একইভাবে তিনি বলেছেন, রোগ দেহকে নয় আক্রমণ করে জীবনশক্তীকে। তাঁর মতে, রোগ প্রাকৃতিক (বা কৃত্তিম) অশুভ শক্তি কিন্তু এ শক্তি জড় নয়। অর্গাননের ১৯ নং এপোরিজমে তিনি জীবনীশক্তি ও রোগের মধ্যে যে যোগসূত্র গড়ে দিয়েছেন এটাই হোমিওপ্যাথির মৌলিক দর্শন: ‘‘জীবনীশক্তি ও জীবনবিরোধীশক্তি (মানে রোগ) উভয়ই অতীন্দ্রিয় ও সূক্ষ্মশক্তি। উভয়ের মধ্যে যে দ্বন্দ্বসংঘাত তাও অতীন্দ্রিয় ভূমির ওপর চলছে, স্থূল ভূমির ওপর নয় এবং উভয়ের দ্বন্দ্বসংঘাতে যে রোগযন্ত্রণার সৃষ্টি হয় তাও সূক্ষ্ম, স্থূল নয়।’’ কাজেই সূক্ষ্ম রোগশক্তিকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্য ডা. হ্যানিম্যান তাঁর ওষুধকে ভেঙে পরমাণুর মতোগ্য করে তোলেন। আরোগ্য প্রক্রিয়ার মূল কথা হলো: সিমিলিয়া সিমিলিবাস কিউরেন্টার অর্থাৎ সদৃশ দ্বারা
সদৃশ আরোগ্য।
আমাদের আলোচ্য বিষয় হোমিওপ্যাথির তত্ত্ব নয় দর্শন। এই মহান চিকিৎসকের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য আমরা তাঁর চিন্তার আরও গভীরে প্রবেশ
করার চেষ্টা করব।
জীবনীশক্তির অবস্থান দেহের মধ্যে। মনের অবস্থানও দেহের মধ্যে। আত্মা বা সত্তার
অবস্থানও দেহেরই মধ্যে। এ যেন লালনের
গানের মতোই: বাড়ির পাশে আরশি নগর সেথায় এক পড়শি বসত করে আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।’ একই দেহে অবস্থান করা এই তিনশক্তি পরস্পরকে কতটুকু চিনে? তাদের মধ্যে সম্পর্কই বা কী? হ্যানিম্যান অর্গাননের ৪২ নং এপোরিজমে বলেছেন:
জীবনীশক্তি
স্বতঃপ্রবদ্ধ কিন্তু বিচারবুদ্ধি তার নেই। শত্রুপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার কোনো কূট-কৌশল তার জানা নেই। তিনি জীবনীশক্তি, মন ও দেহসত্তার মধ্যে এভাবে সম্পর্ক গড়ে দিয়েছেন: জড়দেহ, জীবনীশক্তি ও বিবেকবুদ্ধি সম্পন্ন মন এই
তিনের mgš^‡q প্রত্যেক মানুষের
চৈতন্যময় ব্যক্তিসত্তা গঠিত।
এখানে একটি প্রশ্ন জাগে যে, ‘চৈতন্যময় ব্যক্তিসত্তা’ দ্বারা তিনি কী বুঝিয়েছেন? ‘ব্যক্তিসত্তা’ আর ‘সত্তা’ তো এক জিনিস নয়। তাহলে ‘সত্তা’ বলতে আমরা যা বুঝি মানে ঈশ্বর, যাঁর অবস্থান প্রতিটি মানবের দেহসত্তায় হ্যানিম্যান কি তাঁকে বাদ দিয়েছেন? কিন্তু অন্যত্র আমরা দেখেছি, তিনি লিখেছেন, অসুস্থ, রুগ্ন মানবতার জন্য হোমিওপ্যাথি ঈশ্বরের
পবিত্র দান। তাহলে তিনি ঈশ্বরকে অস্বীকার করেননি বরং অনেক বেশি মহামান্বিত করেছেন উপর্যুক্ত বক্তবের দ্বারা।
এভাবে আলোচনা করলে দেখা যায়, হ্যানিম্যানের জীবনীশক্তি কখনো ‘মন’ আর কখনো ‘রোগপ্রতিরোধ শক্তি’। আবার কখনো মনের সঙ্গে এর সম্পর্ক সাংঘর্ষিক আর কখনো সহযোগী। কারণ রোগ নির্ণনে শারীরিক লক্ষণের চেয়ে মানসিক লক্ষণে বেশি জোর
দেয়া হয়। হালের বিশ্বখ্যাত ভারতীয় চিকিৎসক রাজেন
শঙ্কর মানসিক লক্ষণ আর
স্বপ্ন বিশ্লেষণ করে রোগের চিকিৎসা
দিয়ে বড় ধরনের সফলতা পেয়েছেন।
দেহের অস্তিত্ব আছে। ‘মন’ দৈহিক আচরণের মাধ্যমে তার প্রকাশ ঘটায়। কিন্তু জীবনীশক্তির কোনো দৈহিক অস্তিত্ব নেই, তাহলে দু’টি অস্তিত্বহীন বস্তু কীভাবে একে অন্যের
মাধ্যমে কর্মতৎপরতা প্রকাশ করতে পারে? অস্তিত্ব বলতে এখানে দৈহিক উপস্থিতি বুঝাচ্ছি। এসব কি শুধু কল্পনা? না, কল্পনা নয়, জীবনীশক্তি ও মন ছাড়াও আরও অনেক বিষয় মানবের
মধ্যে নিহিত আছে যেমন জ্ঞানচেতনা, দুঃখশোকের অনুভূতি, ভালোবাসা-ঘৃণা-হিংসা-বিদ্বেষ, চৌর্যচিন্তা ও শিল্পমনষ্কতা। ভাববাদীরা যেমন
ধরে নেন, পৃথিবীতে অনেক বস্তু ও শক্তি
আছে যেগুলো আমরা দেখি না। একইভাবে আছেন
সর্ববিষয়ের এমনকি রোগ-শোক ও হাসি-কান্নারও নিয়ন্ত্রক ‘সর্বশক্তিবান ঈশ্বর’। হোমিওপ্যাথি এসব
গুণ বা নির্গুণবাচক বিষয়গুলোকে লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করে। হাবাগোবা, পরিবেশের প্রভাবে সাড়া দিতে
পারে না এমন বিষয়কেও লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করে। এখানেই অন্যান্য সকল চিকিৎসা পদ্ধতি থেকে হোমিওপ্যাথি ভিন্ন, এটির তার সফলতার অপার গোপন রহস্য।
এই মহান চিকিৎসাবিজ্ঞানির ২৬০তম জন্মদিন আজ। এই দিনে ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির মিসেন নগরীতে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন এবং ২
জুলাই ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে মৃত্যুবরণ করেন।
গাজী সাইফুল ইসলাম
লেখক, অনুবাদক ও হোমিওপ্যাথির গবেষক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন